বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচাবে গাজর!
গাজর অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং খাদ্যআঁশসমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি, যা প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। তরকারি ও সালাদ হিসেবে গাজর খাওয়া যায়। এ ছাড়া গাজর দিয়ে অনেক সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায়। তবে রান্না করে খাওয়ার চেয়ে গাজর কাঁচা খাওয়া বেশি ভালো। কারণ এতে পুষ্টির অপচয় কম হয়। গাজরের পুষ্টিগুন ও স্বাস্থ্য উপকারিতা গুলো জানার পর , আমি নিশ্চিত যে এরপর আপনাদের খাবার তালিকায় অবশ্যই নিয়মিতভাবে গাজর থাকবে।
যেসব রোগ সারাতে সহায়কঃ
ওবেসিটি, মাড়ির সমস্যা, ইনসম্নিয়া, কিডনি, লিভার ও গলব্লাডারের সমস্যা, আলঝিইমার, অ্যাজমা কোলাইটিস এবং চোখের সমস্যা।
গাজরে যে উপাদানগুলো রয়েছেঃ
শীতকালীন সুস্বাদু, পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং উচ্চ ফলনশীল এই সবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটিন যা ক্ষুদ্রান্ত্রে গিয়ে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়। গাজরে প্রাপ্ত ক্যারোটিন কচুশাক, কলমিশাক, লালশাক ও পুঁইশাক বাদে অন্যসকল শাকসবজি ও ফলের চেয়ে বেশি। নিয়মিত গাজর খেলে ক্যারোটিন তথা ভিটামিন এ’র অভাব পূরণ হয় যার ফলে দৃষ্টিশক্তি ভাল থাকে এবং অন্ধত্ব ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
এছাড়াও এত রয়েছে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি অক্সিডেন্টসহ। ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ভিটামিন সি ও ফাইবার পটাশিয়াম।
গাজরের সবচেয়ে বেশি উপকারঃ চলুন এবার জানা যাক গাজরের উপকারিতা গুলো সম্পর্কে–
ওজন কমায়: গাজর হচ্ছে কম ক্যালরি যুক্ত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ সবজি যা কাঁচা খাওয়া যায়। কেটে টুকরো করে এমনি বা সালাদ তৈরি করে নাস্তা হিসেবে খাওয়া যায়। এটি খেলে বেশ কিছুক্ষন পেট ভরা থাকে বলে ক্যালরিবহুল অন্য খাবার খেতে হয়না। যার ফলে তা ওজন কমাতে সহায়ক হয়।
দাঁত পরিষ্কারে: তাজা ও কচকচে গাজর খেলে তা দাঁতকে সুস্থ ও পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে: ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে গাজরের জুস হচ্ছে একটি উত্তম খাবার। এটি সুস্থ ত্বক পেতেও সাহায্য করে।
চোখের সুস্থতার জন্য: সুস্থ চোখের জন্য গাজরের চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। গাজরে থাকা ভিটামিন এ হচ্ছে মূল উপাদান যা চোখের সুস্থতার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। আর গাজরে এই ভিটামিন এ রয়েছে অনেক বেশি পরিমানে।
ত্বকের সুস্থতা: বিটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর একটি সমৃদ্ধ উৎস হচ্ছে গাজর যা ত্বককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের ক্ষেত্রে গাজরের অন্যান্য উপকারিতার মাঝে বলিরেখা প্রতিরোধ করা অন্যতম।
রক্তের অম্লতার ভারসাম্য বজায় রাখতে: গাজর আমাদের দেহের রক্তকে বিশুদ্ধ করার পাশাপাশি গাজরের মাঝে থাকা ক্ষারধর্মী উপাদান এর অম্লতার ভারসাম্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অ্যান্টি অ্যাজিং: গাজরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে নরম রাখতে এবং ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই এটা তারুণ্য ধরে রাখতে সক্ষম একটি খাবার।
পচন রোধ করে: গাজর এর জীবানুনাশক গুনাগুনের জন্য বিখ্যাত। তাই এটি পচন রোধ করতেও সাহায্য করে।
অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের বিরুদ্ধে লড়ে: গাজরে থাকা পটাশিয়াম রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে যার ফলে রক্ত ঠিক ভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং রক্ত জমাট বেধে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: এই সবজি রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে যেমন অ্যাথেরোসক্লেরোসিস প্রতিরোধ করে সেই সাথে উচ্চ রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
অ্যান্টি কার্সিনোজেন: গাজরে falcarinol নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা স্তন ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার এবং ফুস্ফুসের ক্যান্সারের প্রি-ক্যান্সার সেল দূর করতে সাহায্য করে।
হাড়ের সুস্থতায়: ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস হওয়ার কারনে গাজর হাড়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এছাড়া লিগামেন্টের সুস্থতায়ও এর ভালো ভূমিকা রয়েছে।
হৃদপিণ্ডের সুস্থতায়: গাজরে রয়েছে আলফা ক্যারোটিন, বিটা ক্যারোটিন এবং লুটেন যা নিয়মিত গাজর খেলে সেগুলো হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
গলাভাঙ্গা প্রতিকারে: গাজরের জুস গলার ব্যাথায় বেশ উপকারি এবং গলায় কফ জমে থাকা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিসের জন্য উপকারি: এই সব্জিটিতে থাকা ক্যারোটিনোয়েড ইন্সুলিনের প্রতিরোধে সাহায্য করে যার ফলে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়।
দেহের বিষাক্ততা দূর করতে: গাজরের জুসে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ থাকার কারনে এটি একটি শক্তিশালী বিষাক্ততা দূর করার উপাদান হিসেবে কাজ করে।
হজমের জন্য উপকারি: গাজরে প্রচুর খাদ্য আঁশ থাকে বলে তা দেহের আভ্যন্তরীণ অন্ত্রের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং হজমক্রিয়াকে উন্নত করে।
রাতের দৃষ্টি উন্নত করে: গাজর চোখের জন্য খুবই উপকারি। রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যা আলোক সংবেদক রডোপসিনের সাহায্য নিয়ে রাতের দৃষ্টিকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
উর্বরতা বাড়ায়: গাজর যখন নিয়মিত খাওয়া হয় তখন তা নারী ও পুরুষের প্রজননের উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে।
চুল পরা কমায়: এই সবজিটি ভিটামিন ই এবং সি তে ভরপুর। তাই এটি মাথার তালুর রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে চুল পরা কমাতেও সাহায্য করে।
প্রদাহ বিরোধী গুনাগুন: প্রতিদিনের খাবার তালিকায় যদি কিছুটা গাজর কুচি বা টুকরো রাখা যায় তাহলে তা প্রদাহের কারনে সৃষ্ট জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে।
প্রতিরোধ ক্ষমতা বর্ধক: গাজরে ভিটামিন সি এর উপস্থিতি এবং অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল গুনাগুনের জন্য এটি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
মায়ের বুকের দুধ বাড়াতে: Galactagogue নামক মায়ের দুধ উৎপাদক উপাদান গাজরে বিদ্যমান থাকার কারনে গাজর খেলে মায়েদের বুকের দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
গর্ভাবস্থার জন্য ভালো: অনেক বেশি ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ গাজর ভ্রূণের সুস্থতার জন্য এবং বৃদ্ধি জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
ব্রনের বিরুদ্ধে কাজ করে: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যারোটিনয়েড এবং বিভিন্ন ভিটামিন নিয়মিত খেলে এবং ত্বকে ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ কমাতে সাহায্য করে।
গাজরের জুসের উপকারিতা
-কাঁচা গাজরের তুলনায় সেদ্ধ গাজর পুষ্টিগুণে ভরপুর। এর জুসও বেশ স্বাস্থ্যকর। কারণ গাজরের জুসে সহজপাচ্য ফাইবার থাকে।
-কাঁচা গাজর খেলে যেখানে গাজরের উপস্থিত বিটা ক্যারোটিনের মাত্র ১ শতাংশ আমাদের শরীরে কাজে লাগে, সেখানে গাজরের জুস খেলে আমাদের শরীরে গাজরের উপস্থিতি পুরো বিটা ক্যারোটিন অ্যাবজর্ব করতে পারে।
-গাজরের জুসে অ্যান্টি কারসেনোজনিক উপাদান রয়েছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
-শিশুদের জন্য গাজরের জুস টনিকের মতো কাজ করে। এটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
-গাজরে রয়েছে ফোটোনিউট্রিয়েট ফ্যালকর্নিকল, যা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
-হাইপারটেনশনের সমস্যায় গাজরের জুস উপকারী।
-গাজরের জুসের সঙ্গে মধু ও কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও রাতে এক গ্লাস খান। কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কমে যাবে।
গাজর স্টোরেজ টিপসঃ
ফ্রিজে গাজর র্যাপ করে রাখবেন। তা না হলে গাজরের স্বাদ চলে যাবে।
গাঢ় কমলা রঙের গাজর বেছে নিন। রঙ গাঢ় হলে বুঝবেন প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিনয়েড রয়েছে। গাজরের গা খসখস হলে না কেনাই ভালো। এগুলো তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
গাজরের গোড়ার রঙ কালো হয়ে গেলে কিনবেন না। গাজরের গোড়া যেন সবুজ থাকে।
একটি ১০০ গ্রাম গাজরে যে সমস্ত পুষ্টি উপাদান রয়েছেঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম গাজরে যে সমস্ত পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা হল- ক্যারোটিন ১০,৫২০ মাইক্রোগ্রাম, শর্করা ১২.৭ গ্রাম, আমিষ ১.২ গ্রাম, জলীয় অংশ ৮৫.০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭.০ মি. গ্রা., আয়রণ ২.২ মি. গ্রা., ভিটামিন বি১ ০০.০৪ মি. গ্রা., ভিটামিন বি২ ০.০৫ মি. গ্রা., চর্বি ০.২ গ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মি. গ্রা., আঁশ ১.২ গ্রাম, অন্যান্য খনিজ ০.৯ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৫৭ ক্যালরি।
যে পরিমানে গাজর খেতে হবেঃ
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে সপ্তাহে ৫ দিন দৈনিক ১টি করে মধ্যম আকারের গাজর খেলে মহিলাদের স্ট্রোকের সম্ভাবনা হ্রাস করে এবং পুরুষের ১০% কোলেস্টেরল হ্রাস করে।সুতরাং বয়স্কদের জন্য গাজর খাওয়া অতি জরুরি। লিউসিন যা আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড যা গাজরে বিদ্যমান রয়েছে। নিয়মিত গাজর খেলে ত্বকের রং উজ্জ্বল হয় এবং পেটের নানারকম সমস্যা দূর হয়, হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্ককে মজবুত রাখে, কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে।